জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সমস্ত আবেগ, অনুভ‚তি, ত্যাগ, সংগ্রাম, বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, অদম্য স্পৃহা, দৃঢ় প্রত্যয়, বাঙালি জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও আদর্শের দ্বারা সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা অর্জনের চ‚ড়ান্ত আত্মত্যাগে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর সহযোগিতায় ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্মলাভ, ’৪৮-এর মার্চে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১১-দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ’-এর নিরঙ্কুশ বিজয়সহ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বাঙালি জাতি তাঁর স্বাধীনতা অর্জনের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিশপথে ঐক্যবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি। শুরু হয় স্বাধীনতার প্রস্তুতি। পুরো বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। সারা বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ কার্যকর। ’এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এ পরিনত হয় সমগ্র পূর্ব বাংলা। পঁচিশে মার্চের ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির নৃশংস ’অপারশেন সার্চলাইট” শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতি বুকের তাজা রক্তে ঢেলে দেয়। ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের আর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শুধুমাত্র শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারেরই ক্ষমতাচ্যুতি ঘটেনি। ঐ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। জনগণের অধিকার, সরকার পরিবর্তনে তাদের ইচ্ছে-শক্তি ও রায়কে অস্বীকার করা হয়েছিল। পচাঁত্তরের ১৫ আগষ্ট বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেই হত্যা করা হয়েছিল। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থান সংঘটিত করে শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযোগীদের হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, নিজেদের ইচ্ছে মাফিক বেয়নেটের ডগায় রাষ্ট্রপতি বানিয়ে, মন্ত্রী সভা গঠন করে, সরকার তৈরি করে সম্পূর্ণভাবে সংবিধান-বিযুক্ত করে ‘সুপ্রা কনস্টিটিউশানাল’ কর্তৃত্ব দিয়ে ’হা-না’ ভোট দিয়ে সমগ্র দেশকে সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল।‘
আগষ্ট মাস বাঙালি জাতির শোকের মাস। এই আগষ্ট মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আরেকটি রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত অধ্যায় সূচিত হয় ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে। ঐ দিন প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড ছুঁড়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় জাতির পিতার কন্যা ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় জননেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও তার দেহরক্ষী নিহত হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পত্নী আইভি রহমানও নিহত হন। ঝরে পড়ে ২৪টি তাজা প্রাণ। আওয়ামী লীগের বহু শীর্ষস্থানীয় নেতা এখনো দেহে বোমার স্প্লিন্টার বহন করছেন। স্পিøন্টারের যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই ঘটনার দেড় বছর পর মারা যান ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনও ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’।
আগষ্ট মাস এলেই যেন অশনি সংকেত নেমে আসে বাঙালি জাতির উপর। বারবার হামলা হয়েছে এই মাসে। ২১ আগষ্টের কিলিং মিশনে অংশ নেয়া হত্যাকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত পুলিশের উপস্থিতিতে ও হাজার হাজার মানুষের ভেতরে ঢুকে প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মিস করলেও একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হয়। ১৫ আগষ্ট ও ২১শে আগষ্ট এই দুই হত্যাকান্ডের মধ্যে পার্থক্য কেবল একটাই, ১৯৭৫ সালে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সফল হলেও ২০০৪ সালে তা হয়নি। কিন্তু ২১শে আগষ্টের দোসররা আজও সক্রিয়।
বাংলাদেশের মানুষের ওপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানীরা যখন চেষ্টা করে তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। বাঙালিরা কেন মারবে। যে কারণে, অনেকেই অনেক ভাবে তাঁকে খবর দিয়েছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি। বাঙালি জাতিকে উদ্ধৃত করে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘ওরা আমরা সন্তানের মত। ওরা আমাকে কেন মারবে।’ কিন্তু জাতির পিতার সেই বিশ্বাসে চরম আঘাত দিয়ে তাঁকেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে কিছু সংখ্যক বিপথগামী। জাতির পিতার খুনিদের রক্ষায় সে সময় ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ জারি করে তখনকার ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরে জিয়াউর রহমান বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালায়। হত্যাকারীদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। জিয়াউর রহমান হত্যাকারীদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়, ব্যবসা করার সুযোগ দেয়, বিপুল অর্থের মালিক করে দেয়। জিয়ার পথ ধরে জেনারেল এরশাদ এই খুনিদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়, রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হবার সুযোগ দেয়, এমনকি ভোট চুরি করে পার্লামেন্টেরও মেম্বার করা হয়। এরশাদ থেকে আরেক ধাপ উপয়ে গিয়ে খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে ভোট চুরি করে পার্লামেন্টে খুনি রশিদকে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসিয়ে দেয়। এছাড়াও আরেক খুনিকে পার্লামেন্টের মেম্বার করে এবং তাদেরকে পুরষ্কৃত করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার পর ষড়যন্ত্রকারীরা এভাবেই সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, খুনী, যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদেরকেই পৃষ্ঠাপোষকতা করে। ১৫ আগষ্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যারা, তারাই মূলত ক্ষমতা দখল করে নেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা বাংলাদেশকে ‘ভিক্ষুকের জাতিতে’ পরিণত করেছিল। বাঙালি মাথা উঁচু করে বিশ্বে দাঁড়াক, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ টিকে থাকুক, বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকুক এটাই তারা চায়নি। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে বুঝতে হবে জানতে হবে এবং সবাইকে জানাতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। ৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র হয়। ২০ বছর ক্ষমতায় থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারায় মৌলবাদের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে। জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানি কায়দায় ’বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ চালু করা হয়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলার নিরন্তর ষড়যন্ত্র চলে। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে মৃত্যুকে জয় করে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার মহান ব্রত নিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি এখনো ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। পেছনে কে ষড়যন্ত্র করেছে, কে কি করেছে সেদিকে নজর না দিয়ে তিনি নজর দিয়েছেন বাংলার ক্ষুধার্ত দরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করে তাঁদের জীবন মান উন্নত করা। এটাই তার প্রথম এবং প্রধান কাজ। তাই আরেকটি ১৫ আগষ্ট বা ২১ আগষ্টের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে বিষয়ে সবাইকে, বিশেষ করে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে। শোককে শক্তিতে পরিনত করে শক্তিমান হয়ে দুর্জনের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
-শিব্বীর আহমেদ, কথাসাহিত্যিক / সাংবাদিক
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র