WASHINGTON BANGLA

মানুষের হৃদয়ে চির ভাস্বর বঙ্গবন্ধু

এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন

বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন ১৫ আগস্ট। ৪৭ বছর আগে এইদিনেবাংলাদেশের ঢাকায় সংঘটিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রত্যক্ষ মদদে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামীসদস্যের হাতে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন স্বাধীনতার মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠবাঙালি এবং বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বেগমফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তারছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী আরজুমনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদসেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। এ সময় বঙ্গবন্ধুরদু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।

বঙ্গবন্ধুর এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতার সূর্য  আরেকবার অস্তমিত হয়ে পড়ে। সেইসাথে স্তব্ধ হয়ে যায় দেশের  শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা। খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র বাংলাদেশকে আবার স্বাধীনতারপূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং ৭১ ‘এর যুদ্ধাপরাধীরা সদর্পেক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদবিচারের হাত থেকে খুনীদের রক্ষা করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালেইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। খুনী মোস্তাক, জেনারেল জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া পরেঘাতকদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায়আসলে ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়।

১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশীটদাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামীর উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে আটবার বিচার কার্যক্রমস্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনসাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদন্ড- প্রদান করেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। ২০০৯সালের ১২ নভেম্বর-২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণকরেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখেমৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৫ আসামীর দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধেআসামীদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

মূলত, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু করে। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করেসামরিক শাসনের অনাচারি  ইতিহাস রচিত হতে থাকে । সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাসকরা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।

পঁচাত্তরের আগস্টের পর থেকে দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর দেশে সামরিক-বেসামরিক লেবাসে এক ধরনের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা বিরাজকরে। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরেআসার পূর্ব পর্যন্ত। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বেতারে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগের অগণিতনেতাকর্মীকে হত্যা এবং অত্যাচার চালিয়ে পঙ্গু করা হয়। কারাগারে বছরের পর বছর কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধু আদর্শে উজ্জীবিত  হাজার হাজার নিবেদিত প্রাণ নেতা-কর্মীকে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই এ সময় শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার-নিপীড়ণে রাতে নিজেদের বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, পাঠ্যপুস্তকে ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমেছাত্র-ছাত্রী ও নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় গণ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুরঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। দু:শাসনের সেই ২১ বছরে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে অনেককিছুই জানতে পারেনি।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা আবার দলের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেন এবংদেশে গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। দীর্ঘ ২১ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং অগণিত নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের পর দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ওনিরপেক্ষ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখহাসিনা দেশের শোষিষ, বঞ্চিত ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যারফলশ্রুতিতে দেশ আবারও উন্নয়নের কক্ষপথে যাত্রা শুরু করে। পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষাআন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় অবদানকে ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করাহয়। টেলিভিশন-বেতারসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার শুরু হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধেরপ্রকৃত ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির জনকের অবিস্মরণীয় অবদান নতুন প্রজন্মসহ দেশের আপামর জনসাধারণেরকাছে স্বমহিমায় পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যর্থ হয়ে যায় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসকদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও স্বাধীনতাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরনীয় অবদানকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা। এর মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হয়েছে যে ইতিহাসকে কেউ মুছেফেলতে পারে না। একদিন না একদিন মানুষের কাছে উন্মোচিত হয় সঠিক, অভ্রান্ত ইতিহাস। যতদিন এই পৃথিবী টিকে থাকবে ওবাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে ততদিন পযন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর অমর কীর্তির জন্য বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বেরকোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক থাকবেন।

বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে আমাদের নতুন শপথ হোক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির জনকের আজীবনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করা l এই শোকাবহ দিনের প্রাককালে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ও তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক: এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন, প্রেস মিনিস্টার,
বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন

Leave A Reply

Your email address will not be published.