WASHINGTON BANGLA

২১ আগস্ট: বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভীষিকাময় কলংকিত দিন

এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন

গত ২১ আগস্ট ছিল ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১৮তম বার্ষিকী। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় কলংকিত দিন। ২০০৪ সালের এইদিনে ঢাকায় সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায়।

এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন:

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা সেদিন অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও এ ঘটনায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকালে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি বিরোধী’ শান্তি সমাবেশে একটি ট্রাকের উপর অস্থায়ী মঞ্চে যখন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আকস্মিক এই হামলায় আরো ৪শ’ জন আহত হন। আহত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা।

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। সমাবেশের সভাপতি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ দেহে বিষাক্ত স্প্লিন্টার দেহে বহন করে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে পরবর্তীতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

ছিন্নভিন্ন লাশ, বিস্ফোরণের শব্দ, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটিতে সেদিন ওই এলাকা হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়। গ্রেনেড হামলার পর ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে গোটা রাজধানীকে। এই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক আছড়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদদে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘জজ মিয়া’ নাটক মঞ্চস্থ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠবাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ওই গ্রেনেড হামলা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।

উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও সংবাদকর্মীদের বর্ণনায় ২১ আগস্ট:

সেই ভয়াল বিকাল ৩টা থেকে দলের মধ্যম সারির নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। ৪টার দিকে শুরু হয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। নেতা-কর্মীরা তখন অধীর আগ্রহে নেত্রীর বক্তৃতা শোনার অপেক্ষায়। যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে।

৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহুর্মুহু ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের বীভৎসতায় মুহূর্তেই মানুষের রক্ত-মাংসের স্তুপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় । রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাজনৈতিক সমাবেশে যে ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়, তা পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই ভয়াল দিনটি বাঙালি জাতি কোনও দিন ভুলবে না। আইভি রহমানসহ ২১ আগস্টের শহীদদের রক্ত কোনদিন বৃথা যাবে না। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে তাদের এই আত্মত্যাগ স্মরণ করবে।

চাঞ্চল্যকর এ মামলায় বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘এ মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সাক্ষ্য, তথ্য-প্রমাণে দেখেছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জঙ্গিগোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাই ছিল ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য। যুদ্ধে ব্যবহৃত সমরাস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র মানুষ এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশে হামলার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেও জানান তিনি।

দীর্ঘ ১৮ বৎসর যাবত ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় আহত চার শতাধিক আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক শতশত বিষাক্ত স্প্লিন্টার দেহে বহন করে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে দূর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তারা বলছেন, যারা মরে গেছে তারাই বেঁচে গেছে, মৃত্যু বেদনা নিয়ে এ বাঁচার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় ছিল।

ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১৮তম বার্ষিকীতে আইভি রহমানসহ ২১ আগস্টের সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ও তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। যারা আহত হয়েছেন তাদের আশু সুস্থতা কামনা করি। সেই সাথে তীব্র ধিক্কার জানাই সেইসব মানবরূপী জানোয়ার এবং নরপিচাশকে যারা এই বর্বর হামলার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত l জোর দাবী জানাই আদালতের রায় অবিলম্বে কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার I এই মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক রহমানসহ অন্যান্য আসামীদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার জোর দাবি জানাই।

লেখক: এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন, প্রেস মিনিস্টার,
বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন

Leave A Reply

Your email address will not be published.