WASHINGTON BANGLA

পরাণের গহীন বনে শতাব্দীর পথিক

সুমন মোড়ল: ‘কষ্ট পেয়েছি বলেই তোমার দেখা পেয়েছি সাঁই/পিচ্ছিল পথ থেকে ক্রমে ছড়িয়েছি হাজার পথে।’ বাংলায় আধ্যাত্মবাদের সীমারেখা নিরূপণের চেষ্টা কিংবা সাঁইয়ের দর্শন-দুনিয়ার চিত্রাঙ্কন- এই দুটো স্পর্ধাকবি দেখাননি; খুব সচেতনভাবে কবির নিজস্ব জগতে লালনের যে বিচরণ সেটা এঁকেছেন ‘এক কুড়ি সাঁইকাব্য’তে। বাংলায় আধ্যাত্মবাদ সবটুক পাখা মেলেছে গীতি কবিতায় কর্ম সম্পাদনের ব্যক্তিগত তাগাদা যে গীতিকবি তার জন্মদান করেছে, বাংলায় সেটা এক পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে লালনের গানে আত্মার সাধন পূর্ণতা পাচ্ছে সেখানে।

আবহমান বাংলা জনপদের ভাষা যেভাবে প্রাণ পেয়েছে সাঁইয়ের গানে গুরুরচরণ ধূলি নিয়ে কবিও সেই পথ মাড়িয়েছেন এক সচেতন পদক্ষেপে। কবির শৈশব, বেড়ে ওঠা মেলার মাঠে বাপজানের বায়োস্কোপ ভিতর থেকে সাঁই হাত নাড়ছেন ‘কী চমৎকার দেখা গেল/আরশিনগর চইলা আইলো/এই ছবিখানকার? প্রাণের সাঁই আমার।’ বাবার হাতে আঙুল রেখে বায়োস্কোপের নেশায় মাতাল শৈশবে সাঁই যেন খেলার সাথী। সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে ঘুম ঘোরে, আধ চৈতন্যে আবার হাজির হচ্ছেন সাঁই ‘মাটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসেরকমারি/ সন্ধ্যা রাতের রাতজোনাকি ঝাপসা ঘুমঘোর।’বাগানের শতফুল হয়ে কখনও, কখনও ঘোর-ঘ্রাণ হয়ে গেরুয়ার ভিতর থেকে সাঁই তাঁর রূপ দর্শন দিয়ে যাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করলে যেনকী ঘটে যাবার শঙ্কা- এক মহৎ সৌন্দর্য নিয়ে আসন পেতেছেন কবির ঘুমঘোরে।

উদ্ভিন্ন যৌবন ধ্যানে আবার আসছেন সাঁই ‘রোজ আসনে বসি আমি ধ্যানের খেলায়/ছবিগুলো নামতে থাকে মেঘের ভেলায়।’ পার্থিব জগতের মায়াজাল এড়িয়ে, অবুঝ ভুলগুলো সব আড়াল করার পথ বাতলে দিচ্ছেন সাঁই ‘হঠাৎ কে নাড়িয়ে দিলো ছায়ার মনিটর/দুইতার এক হয়েছে জ¦লে হৃদমাঝার।’ কবি শুরুতে সেই ছায়াটিকে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন অথচ পরাণের গহীনে বেজে উঠছে শরতের গান, কীসের যেন হাতছানি! এ কী ঝরনা তলার সেই পাগল? গান ধরলে যে ছোটে ছাতা নিয়ে মায়াজাল টুটিয়ে কবিও দিলেন ছুট পাগলের পিছু ‘পড়ে থাকলো জরির জীবন রেশম জলেরক্যান একতারা হাতে নিলাম এবার মায়া মন্দিরাটা আন।’ কবি বেরিয়ে পড়লেন ঠিকই কিন্তু ভূখ-ের সীমানা ভেদ করতে পারলেন না। কবি স্বীকার করে নিচ্ছেন ‘বর্ডারে সাদা আর খাকি রঙের বড়াই চলছে/ফুলপাখি প্রজাপতি ডাকলে বাউল শুধু কাঁদে/দলধরা মানুষের যাওয়া-আসা লাইনে লাইনে।’ সংসারের মায়াজাল ছিন্ন করে এক বিশ^ সংসারের মুখোমুখি হচ্ছেন কবি এখানে। বাউল মন এখানে হয়ে উঠছে বহুমাত্রিক এবং রাজনৈতিক বোকা মানুষের কাঁটাতারের সীমানাকে সমালোচনা করছেন কবি এখানে ‘মড়া পড়ে থাকে কাঁটাতরের ওপারে/বিষাদ সুরে মাঝরাতে বিরাট তুফান/নড়বড়ে কেন রাতের সীমানা পিলার!’ সংঘবদ্ধ সীমানা ভাঙতে ব্যর্থ মনোরথে কবি ফিরে যাচ্ছেন তাঁর মাটির পৃথিবীতে। কবি লিখছেন ‘বাজপাখি বায়ু মানচিত্র ভাঙছে আকাশে/মনবাউল সীমানারেখা ভাঙতে পারে না।’ ফেরার ক্ষণে কবি স্মরণ করছেন ‘কালো দিগন্ত রেখার কাছে আমার মাটির ঘর/সে ঘরে নারী এবং শিশুরা রোজহল্লা করে/আমি বনবাস থেকে পোড়ামাটির ঘ্রাণ পাই।’ সাঁইয়ের বহুমাত্রিকতাকে কবি পেয়েছেন, যেভাবে পেয়েছিলেন গুরুরচরণধূলি। কবি কখনও ব্যক্তিক থেকে সামষ্টিকে পরিণত হচ্ছেন আবার সময়মতো সেজদা করছেন সংসারধর্মের ‘রোজ রাতে তোমার বালিশ বদল খেলা/আমার এখানে শিথান পৈথান একাকার।’ কিংবা ‘অপেক্ষায় রাঙা বৌয়ের স্বপ্ন উড়াল দিলো/দানাধরা চিন্তা থেকেই দিগন্ত রেখার শুরু।’ কবি পুরাদমে সংসারী হয়ে উঠছেনÑ ‘নদীর এপারে আমাদের কল্পনার সংসার/রান্নাবাটি তেলবণ আর মরিচের ব্যবধান।’ একই সঙ্গে কবি হয়ে উঠছেন নীলকণ্ঠ বাউল যেন ‘নদীতে মিশে যায় ¯œানের জল/বৃক্ষমায়ায় কাঁদে নিথর শরীর।’ কবি পীড়ায় ভুগছেন, বাড়ছে সাঁইয়ের অপেক্ষা। ঘুমঘোরের বাউল যেন ধরা দিতে চায় না, কবেকার কোন অসীমে দিয়েছে উড়াল জীবনের কোন অৎানা বীক্ষণে। অপেক্ষা বাড়তে থাকে, এই বুঝি এলোসাঁই ‘হিম হয়ে আসে পদ্মবিলের জল/পাঁচ দোহার আসন পাতে/আসে না পরাণ সাঁই; বাজে না সাধের দোতারা।’ তবে কি পথ হারিয়েছে সাঁই? ‘সুরের মায়ায় অন্ধব্রতচারী হারিয়েছে পথ/ডাকিনি সময় জড়ো হয় যমদূতের মতো/ধাবমান মৃত্যু ফিরে যায় মাটির ঘরে।’ কবির অপেক্ষার পালা ফুরোচ্ছে। সাঁইজির বারাম খানায় বিলাপ উঠেছে, কেঁদে ফিরছে দোতারা, শোনা যাচ্ছে যমদূতের বুটের আওয়াজ। কবি বলছেন, ‘জোরসে বাজাও নাকারা ঢোল/কৃষ্ণকাঠি আর মাদল।’

অন্তিম ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক সীমানায় ‘প্লাবণে পাহাড় ভাঙে, ভাঙতে থাকে মায়ার খেলা/হ্যালোজেন জ¦লে উঠলে চোখের তারায় নামতে থাকে/মাথার ভেতর বাজতে থাকে, বাউলকার মারফতি গান।’ পথ ছেড়ে যাবার আগে কবি শুনিয়েছেন কিছু আক্ষেপ আর বেদনার গান। ‘কবিগান থেমে গেছে কবে/ট্রাক্টর চলে এসেছে ডিজিটাল উঠোনে।’ স্মৃতিচারণ করেছেন ‘অভুক্ত দিন কেটে যায় মন বাউলের সাথে/লণ্ঠন নিভে গেছে আজ, আলো নেই কোথাও।’জন্ম-মৃত্যু-পরকাল ভুলে সকাল-দুপুর-রাত্রে ঘুরে বেড়ানো বোহেমিয়ান মন ‘সারাধামে পায়ের ছাপ/খুঁজে ফেরে ইন্দ্রজিৎমন/আসমান-জমিনমিলন বিন্দু।’ সাঁইজি কি আসবেন যূথচারী আঁধারে? কবির কল্পমন বলছে ‘সাঁইজি আমার আন্ধার ধামে দৃশ্যলোকে আসে/পরাণ আমার বাউল বেশে তারই সুরে ভাসে।’ কবি শেষ করছেন এভাবে ‘সব আলো নিভে যায়/শব্দ নৈঃশব্দ্যের রঙছড়ায়/পৃথিবী তখন গভীর তন্দ্রায়/আঁধার জলে ডুবে জেগে থাকি সাঁই আরআমি।’

Leave A Reply

Your email address will not be published.