WASHINGTON BANGLA

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ছোটগল্প

ড. রকিবুল হাসান : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কিংবা অসংখ্য শানিত কলাম রচনার জন্যই নয়-পঞ্চাশের দশকে যে কজন কথাশিল্পী জীবন ও সমাজকে পাশাপাশি রেখে সমাজবাস্তবতার অম্লমধুর গান গেয়েছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (জন্ম ১৯৩৪, মৃত্যু ২০২২) তাদের মধ্যে অন্যতম। কেননা শিল্পীমাত্রই সমাজজীবনের অনুসন্ধিৎসু দর্শক-সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়-অবিচার, অনাচার-ব্যভিচার, জ্বালা-যন্ত্রণা, জীবনের উন্মত্ততা ও নগ্নতাকে পছন্দমতো শৈল্পিক উপাদানে কলমের আঁচড়ে সাহিত্যে তুলে ধরেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি সামন্তবাদ ও বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অসংগতিগুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে তাঁর গল্পের আলোকে বিষয়টি চিহ্নিত করার প্রয়াস পাব। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। গ্রন্থগুলো হলো ‘সম্রাটের ছবি’ (১৯৫৯), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬) ও ‘সুন্দর হে সুন্দর’ (১৯৬৭)।

‘সম্রাটের ছবি’ গ্রন্থের ‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি সামন্ততন্ত্রের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এ গল্পে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তৎকালীন জমিদারদের বৃটিশপ্রীতির এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে দেশ স্বাধীনের পরও ব্রিটিশদের প্রতি তাদের অন্ধ প্রীতির আলেখ্য চিত্রিত করেছেন। গল্পের নায়ক যুবক জমিদার উমর আলী খান। তিনি ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য ও সাহায্য-সহযোগিতার জন্য পেয়েছেন ‘খানবাহাদুর’ উপাধি। এর মধ্যে তার জীবন থেকে ঝরে পড়েছে ৪০টি বছর। তার সংসার বড় হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা। তবুও প্রাচীন ঐতিহ্যকে লালন করার জন্য তিনি বহন করছেন ‘সম্রাট জর্জ দ্য ফিফথ’-এর ছবি।

সেগুনকাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি দীর্ঘ সময় পাড়ি দিলেও তার জৌলুস এখনো বিলুপ্ত হয়নি। খানবাহাদুর এখনো ছবিটিকে ঋষিতুল্য ভক্তি করেন। তাই তো চাকরকে কাঁধের ময়লা গামছা দিয়ে ছবিটি পরিষ্কার করতে দেখে খানবাহাদুর হা-হা করে গর্জে উঠে বললেন, ‘করছিস কি, করছিস কি হারামজাদা? তোর ময়লা গামছা লাগিয়েছিস ওই ছবিতে! শালা জানিস ঐ ছবি কার, তোর বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ যার নিমক খেয়ে মানুষ। দৌড়ে যা, আমার টার্কিশ তোয়ালেটা নিয়ে আয়। তারপর ফের ধুয়ে রাখিস।’

অন্যদিকে তার ছেলে মনসুর সদরের তরুণ উকিল। জেলা জজের ছোট জামাই। মনসুরের স্ত্রী রিজিয়া আধুনিক শিক্ষা ও জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। মনসুর ব্রিটিশপ্রীতিকে উপেক্ষা করে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে। বৈঠকখানার সোফায় সাধারণ প্রজাদের বসার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু খানবাহাদুর এসব সহ্য করতে পারেন না। তবুও ছেলের যুক্তির কাছে হার মানেন। আরও হার মানেন ছেলে ও বউমার সুকৌশলে সামন্ততন্ত্রের আঁকড়ে ধরা শেষ চিহ্নটি উৎখাত করার সময়। তখন খানবাহাদুর রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তিনি আরও ক্ষুব্ধ হন ৪০ বছর আগে শয্যাগৃহে রাখা মহারানি ভিক্টোরিয়ার যুবতি বয়সের ছবিটি সরানোর পর। বিবির অজ্ঞতা ও মূঢ়তা দেখে তিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন-‘জান ছবিটি কার? রামা-শ্যামা তোমার আমার নয়, রাণীর-হারম্যাজেস্ট্রি কুইনের; যার রাজ্যে বাস কর।’

তবুও বিবি তার জিদ বহাল রাখেন। কারণ মেয়ে মানুষ তো। মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষকে সহ্য করতে পারে না। তারপরও আবার যুবতি রানি। তাই তো ৪০ বছর পর বাতের ব্যথায় ক্লান্ত ও মেদবহুল বিবি ছেলের বউয়ের ঘরে ঢুকে সেই ছবিটি দেখে সরস্বতী বাঁদীকে ডেকে বললেন-‘ওই রাণী মাগীর ছবি এখানে কেন?’ শুধু তাই নয়, বউমার ঘরে অশ্লীল ছবি দেখে বলেছেন-‘এগুলো কি ছবি বৌ! মেম সাহেবরা ন্যাংটো হয়ে নাচছে। এগুলো কি ছবি? এদের জাত, মান, পর্দাপুষিদা, ইজ্জত আছে?’

এখানেই চরিত্রটির মনস্তাত্ত্বিক দিকের পরিস্ফুটন ঘটেছে। ‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি রোমান্টিক আবহে নির্মিত একটি মধুর রসের গল্প। এখানে মানবজীবনের জটিলতাকে উন্মোচিত করে একটি জীবনতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিচারে গল্পটি পাঠকনন্দিত হতে পেরেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘নীল কমল’ গল্পে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারের অভ্যন্তরীণ জীবন-জটিলতার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এ পরিবারের সামন্ত প্রতিভূ শমসের আলী খান। একসময় তার জমিদারির জৌলুস ছিল।

কালক্রমে তা নিঃশেষ হতে চলেছে। লেখক তার ক্ষয়ে যাওয়া সামন্ত প্রাসাদের বর্ণনা দিয়েছেন।

‘অন্য কোনখানে’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এক নাগরিক জীবনের জটিলতার গল্প।

নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ অভাব-অনটনে পড়ে কীভাবে চরিত্রের স্খলন ঘটান এবং সমাজের উচ্চশ্রেণিতে পরিণত হন, এর এক বাস্তব চিত্র এ গল্পে ফুটে উঠেছে। গল্পের নায়িকা মিস নীলিমা নাসরিন। সে গ্রাম্য সহজসরল বিএ ফেল যুবকের স্ত্রী। চাটগাঁর লাভ লেনের ভাঙাবাড়িতে তারা বসবাস করত। স্বামীর টাকা নেই, মূলধন নেই। স্বামীর কারণেই এই ভাঙা বাড়ির সামনে মাঝেমধ্যেই মোটর এসে দাঁড়াত। ধনাঢ্য মানুষের আগমন ঘটত। কিন্তু নীলিমা এসবে প্রবল আপত্তি করত, বাধা দিত এবং নিরুপায় হয়ে কান্নাকাটি করত। অথচ তার স্বামী অনড়। কারণ নীলিমা তার বিয়ে করা বউ। বউয়ের ওপর তার যথেচ্ছা অধিকার রয়েছে। এই অধিকারকে পুঁজি করে নিজের বউকে বাধ্য করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গ দিতে, তাদের মনোরঞ্জন

করতে। অবশেষে স্বামীর অনৈতিকতা ও অপ-ইচ্ছার কাছে হেরে নীলিমা গ্রাম্যবধূর পোশাক খুলে আধুনিকা হয়ে ওঠে। আর এর পেছনে ইন্ধন জোগায় জোয়ারদার। ঠিক ১০ বছরে নীলিমা মোহনীয় ও ধনবতী মহিলায় পরিণত হয়। বর্তমানে সে কসমোপলিটান ট্রেডার্সের সেক্রেটারি। স্বামী আশরাফ আলম তার হেড ক্লার্ক। স্বামীর সামনেই সে ইভেনিং রিক্রিয়েশন করার জন্য ওভারসিজ এজেন্সির ডিরেক্টর মি. ডানকান, নজফ খোরাসানি, গ্রিন হিলের জোয়ারদারকে ডাকেন। এসব ঘটনায় আশরাফ আলম মলিন বিমর্ষতায় কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন।

‘সুন্দর হে সুন্দর’ গ্রন্থের ‘সুন্দর হে সুন্দর’ গল্পটি বাঙালি জীবনের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অম্লমধুর বাস্তবের আলেখ্য। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না। বাঙালি জীবনে বিষয়টি একই সুতোয় গাঁথা। তাই সুখ ভোগ করতে গেলে দুঃখ-কষ্ট তার জীবনে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে গেলে অসুন্দরও তেমনই দানা বেঁধে ওঠে। অমসৃণ পথে পা বাড়ানোর চিত্র উন্মোচন করে সমাজবাস্তবতার এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। মানুষ জীবন ও জীবিকাকে সুন্দর ও মসৃণ করে তুলতে চায়। তাই সামাজিক প্রতিকূলতায় প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রাম করতে হয়। গল্পটিতে সমসাময়িক কালের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অবহেলিত ও অত্যাচারিত একজন

হতদরিদ্র প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের জীবন জটিলতার বাস্তব চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

কলামিস্ট, কবি, এবং নাট্যকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বাংলাদেশের ছোটগল্পে অবদান প্রাতিস্বিক। তিনি সমাজবাস্তবতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই তার ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্র্যের পসরা সাজিয়েছেন। সেই সঙ্গে শিল্পনৈপুণ্যের সমারোহে গল্পগুলোকে করেছেন কালোত্তীর্ণ। বিষয়ভৈবব ও শিল্পগুণের নিক্তিতে তার ছোটগল্পগুলো উচ্চমার্গের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave A Reply

Your email address will not be published.